“দেউশি” এই নেপালী শব্দটি এসেছে মুলত “দেউশিরা” থেকে। এই “দেউশি” উৎসবটি নেপাল, সিকিম, পশ্চিম বংগের পাহাড় ও ডুয়ার্সে পালিত করা হয় নেপালী ভাইটিকার দিনে।
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে বিষ্ণু ভগবান বামন রুপে মর্তের দানি বলি মহারাজা থেকে তার তিন পা জমি দান করতে বললে সে রাজি হয়ে বামন ভগবানকে তিন পা জমি দান করে। বামন ভগবান তার এক পা সমগ্র আকাশ আরেক পা সমগ্র পাতালে রাখলে তৃতীয় পায়ের জন্য কোনো স্থান না থাকায় বলি মহারাজা বামন ভগবানের কাছে জানতে চায় দান বড়ো না দাতা বড়ো সেটির উত্তরে বামন ভগবান দাতাই বড়ো বলায় বলি মহারাজা নিজের মাথায় তার শেষ চরণ রাখতে বললে তাতে বামন ভগবান খুশি হয়ে তাকে শ্রেষ্ঠ দাতার বর প্রদান করে। এই মাথা দান করাকেই নেপালীর দেউ+শিরে = দেউশি শব্দটি এসেছে।যা দান থেকে দাতাই শ্রেষ্ঠ বোঝাতে এই “দেউশি” উৎসব।



এই “দেউশি” উৎসবটি নেপালীদের ভাইটিকা বাঙালির ভাই ফোঁটা উত্তর ভারতে ভাইদ্বুজের দিনে পালিত করে। এই নেপালী ভাইটিকার দিনে ডুয়ার্সের বড় থেকে বাচ্চারা সবাই মেতে উঠে দেউশিতে।নেপালীদের পাঁচ দিনের তিহার উৎসবের শেষের দিন ভাইটিকা পালিত করে ডুয়ার্সের তথা পাহাড়ের নেপালীরা।
তিহার উৎসবের এই পাঁচ দিন নেপালীরা প্রথম দিন কাক তিহার বা ধনতোরষ, দ্বিতীয় দিন কুকুর তিহার চতুর্দশীতে, তৃতীয় দিন গাই তিহার লছ্মি পূজা অমাবস্যায়, চতুর্থ দিন কার্তিক শুক্লপক্ষের প্রথম দিন গোরু(ষাঁড়) তিহার গোবরধন পুজো এবং পঞ্চম দিনে কার্তিক শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় চন্দ্র দিবসে ভাইটিকা মানায়।
এই ভাইটিকায় বোনেরা ভাইদের লম্বা আয়ু সাথে জীবনে সুখ সমৃদ্ধির জন্য সাতরঙি মখমলি টিকা,গাঁদা ফুলের মালা,দুরবো ঘাস, সরষে তেল, আখরোট ভাইকে প্রদান করে শেষে ভাইকে মিষ্টি ও তাদের ঐতিহ্যবাহি “শেল রুটি”(যা চালের গুড়ো, আটা, চিনি ময়দা, ঘি ও তেলে ছেঁকে তৈরি করে যা তাদের তিহার,ভাইটিকা,অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও বিবাহতে দরকার হয়) সাথে অর্থ দান করে। এই ভাইটিকাকে কেন্দ্র করেই মেতে উঠে ডুয়ার্সের তথা পাহাড়ের কোণা কোণা। মাদলের তালে তালে দেউশি গানে মধুর সুরে মেতে উঠে ছোটো থেকে বড় প্রত্যেকেই।শুধু নেপালী বলে নয় ডুয়ার্সের বাঙালি, বিহারি, আদিবাসি প্রত্যেক এই দেউসি খেলায় মেতে উঠে।
এদিন নেপালী পুরুষ মেয়ে ও বৌ সকলেই সবাই নিজেদের ট্রেডিশনাল পোষাক যেমন পুরুষেরা মাথায় ঢাকে টোপি, দরওয়া ও সুরুযাল,কপালে মখমলি টিকা,গলায় গাঁদা ফুলের মালা, মেয়েরা চৌবন্দি, চোলো, কানে ধুঙরি ও নাকে বুলাকি এবং বৌয়েরা মখমলি শাড়ি পড়ে দেউশিতে সামিল হয়ে গ্রামের প্রত্যেকটা বাড়ির উঠানো গিয়ে মাদলের তালে তালে হাতের করতালির সাথে নাচতে এবং দেউশি গান গাইতে থাকে। নাচ-গানের শেষে বাড়ির মহিলা বা পূরুষ একটি থালায় প্রদিপ জ্বালিয়ে ফুল ও চাল নানা রকম মিষ্টি, শেল রুটি এবং নিজের সাধ্যের অনুসারে অর্থ দক্ষিণা হিসেবে প্রদান করে।
আপনাদের অনেকেই হয়তো ডুয়ার্সে কিংবা পাহাড়ে ভাইফোঁটার দিনে এই নাচ গানের অনুষ্ঠানটি দেখে থাকবেন যা আপনাদের কাছে একটা মনোরঞ্জন মনে হলেও এটি ডুয়ার্স তথা পাহাড়ের একটি অন্যতম সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।
(এই লেখাটি উৎসর্গ করলাম আচার্য শ্রী নেত্র প্রসাদ গুরুগাই, (বিরপাড়া) মহাশয়কে)
