ব্রিটিশ – ভারতের শাসন কালে জয়ন্তী তখন খনিজ শিল্পঞ্চল এবং চা শিল্পাঞ্চলে আত্মনির্ভর হয়ে উঠেছিল। ব্রিটিশ ভারতের কোষাগার তখন অনেকটাই জয়ন্তী নির্ভর হয়ে উঠেছিল। জয়ন্তীর চারপাশে বড় বড় ইউরোপিয়ান চা শিল্প – খনিজ শিল্প গড়ে ওঠায় তাদের মাল সরবরাহ করতে ভীষণভাবে অসুবিধা দেখা দিলে তারা তখনকার কুচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়নের সাথে জয়ন্তীতে রেল স্থাপনের আবেদন জানায়। কোচবিহারের মহারাজা ব্রিটিশ -ভারত সরকারের আবেদন গ্রহন করে কোচবিহার স্টেট রেলওয়ে সাথে গীতালদহ থেকে জয়ন্তী রেল লাইন ১৯০১ সালে স্থাপিত করে।
প্রথম মালগাড়ির রূপে জয়ন্তীতে প্রবেশ করে। জয়ন্তী খনিজ শিল্পাঞ্চল হওয়ায় ট্রেনে করে ডলোমাইট, চুনাপাথর, জয়ন্তী নদী ছোট বড় পাথর,চা,কাঠ এই ট্রেনে করে দেশের অন্য স্থানে চলে যেতে শুরু করায় জয়ন্তীর রেল পরিষেবা খুব ভীষণভাবে প্রচলিত হয়ে পড়ে।পরবর্তীতে ৪টি প্যাসেঞ্জার কামরা নিয়ে শুরু হয় জয়ন্তী তে প্যাসেঞ্জার ট্রেনের পরিষেবা। ইউরোপিয়ান চাবাগানের ম্যানেজার প্রত্যেকই এই ট্রেনে করেই যাতায়াত করতেন।ইউরোপিয়ান ন’টা চা-বাগানের মাল পত্র জয়ন্তী নিয়ে আসা এবং কলকাতায় টি বোর্ডে চা পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতো এই ট্রেনটি।




এই রেলের প্যাসেঞ্জার ট্রেনটির ভারত স্বাধীন হওয়ার পর আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে রাত্রি ০৮ঃ৩০ সে ছাড়তো জয়ন্তীতে এসে পৌঁছাতো রাত্রি ১০ঃ৩০ টায়।পরের দিন সকালে ৬টায় জয়ন্তী থেকে ছাড়তো এবং আলিপুরদুয়ার জংশন পৌছাতো সকাল ৯ টায়।প্যাসেঞ্জার ট্রেনের কামরা গুলির মধ্যে একটা কামরা ডাকের জন্য ব্যবহৃত হতো। আর.এম.এস সেন্টার আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে সেই কামরাতে রাজাভাতখাওয়া – বক্সা এবং জয়ন্তীতে ডাক আসতো।রেলের স্টাফ পরিষেবার জন্য রেলের হাসপাতাল, জল বিভাগ, রানিং সেড এর মতো ব্যবস্থা ছিল জয়ন্তি জুড়ে। প্রায় ৬০ থেকে ৭০ জন কার্মীক পরিসেবা দিতো রেল দপ্তর কে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর প্যাসেঞ্জার ট্রেনের পরিষেবা তুলে দিয়ে মাল কামরা গুলির সাথে ৩টে কামরা জুরে দিয়ে এই পরিষেবা বহাল রাখে রেল দপ্তর। এবং টাইম পরিবর্তন করে ৬ কিংবা ৭ দশকে। আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে সকাল ৬ টা এবং জয়ন্তী থেকে দুপুর ১২ টা সময় ছাড়তো।
সারা বছর জয়ন্তী নদীর থেকে রেল দপ্তরের হয়ে পাথর পাঠাতো জয়ন্তীতে স্থাপিত সিন্ধিয়া কোম্পানি। নতুন করে রেলওয়ের ব্রড গেজের লাইন কিংবা মিটার গেজ বা ন্যারো গেজের লাইনে ব্যবহৃত হওয়া অনেকটাই পাথর যেত বগি তে করে জয়ন্তী থেকে।জয়ন্তী- গিতালদা এই রেল লাইনের উপর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে মাল বগি আসতো জয়ন্তীতে ডলোমাইট নিতে এবং এই ডলোমাইট চলে যেত বাংলাদেশের চট্টগ্রাম স্টিল ফ্যাক্টরিতে।
জয়ন্তী নদীর ধারে রানিং সেড এর বন্ধোবস্ত থাকায় রেলের ড্রাইভার,গার্ড এবং অন্যান্য স্টাফ রা জয়ন্তীতে রাত্রিবাস করতো।সেই সময় যারা জয়ন্তীতে ট্রেনে করে আলিপুরদুয়ার থেকে যাতায়াত করতেন তারা এই রেল পথের রোমাঞ্চকর যাত্রা আজও তাদের মন থেকে বের করে দিতে পারেনি। হৃদয়ে এক আলাদা অনুভূতি তৈরি হতো এই জয়ন্তী আলিপুরদুয়ার রেল যাত্রায়।কত লেখকের সাহিত্যে ,গল্পে আজও অক্ষয় হয়ে আছে ট্রেনে জয়ন্তী যাত্রার কথা ।রেলের প্যাসেঞ্জার পরিষেবার মধ্যে টিফিন তথা জল খাবার এবং ভোজনের জন্য দুটো ক্যান্টিন ছিল জয়ন্তী রেল স্টেশনের পাশে । সে ক্যন্টিন দুটি আজও জয়ন্তীর বুকে প্রফুল্ল এবং গণেশ হোটেলের রপে বেঁচে আছে জয়ন্তী বাসস্ট্যান্ডের বুকে। জয়ন্তী থেকে 4 কিলোমিটার দূরত্বে বালা নদীর বুকে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক রেলের ব্রিজের দুটো পিলার।ভাঙা ধ্বংসস্তূপের জয়ন্তীর রেলের অস্তিত্বের প্রমাণ নিয়ে আজও রয়েছে রেলের কোয়াটারের একাংশ।




১৯৮৬ সালে বক্সা টাইগার রিজার্ভ ঘোষণা পর পুরোপুরিভাবে জয়ন্তীর বুক থেকে তুলে নেওয়া হয় এই জয়ন্তীর ঐতিহাসিক রেল পরিষেবা। উপড়ে ফেলে দেওয়া হয় জয়ন্তী বুক থেকে রেললাইন, পড়ে থাকে শুধু রেললাইনের উপর বিছানো পাথর।
কিছু রেল স্টেশন মাস্টারের নাম তুলে ধরলাম যারা জয়ন্তীতে কর্মরত ছিলেন (জয়ন্তীর পুরানো বয়স্ক ব্যক্তিদের থেকে পাওয়া) ১.শ্রী সুবোধ কর (১৯৫২-১৯৫৬), ২.শ্রী ননী গোপাল রায় (১৯৫৬-৬৯), ৩.শ্রী অনিল রায় ঘটক ( RSM.১৯৫৭-৫৯), ৪.শ্রী সুনিল চন্দ্র গোন(১৯৬৮-১৯৭১) ৫.শ্রী বিধু ভূষণ সিংহ (১৯৭২ -৭৭) ৬.শ্রী মণীশ লাহিড়ী (১৯৭৮-১৯৮৬)মাল অফিসার ছিলেন মিঃ বোস(পুরো নাম জানা নাই)। তখন কার কিছু স্টাফ দের নাম যারা জয়ন্তীতে রেলে কর্মরত ছিলেন শ্রী নরেশ চন্দ্র ভাদুরি, কম্পাউন্ডার শ্রী জ্ঞানেন্দ্র দাস, শ্রী পি রামমূর্তি নাইডু,শ্রী রঘুনন্দন সা,এম.ডি হালিম,শ্রী গোপাল চন্দ্র দাস, শ্রীকান্ত গোয়ালা, শ্রী যোগেশ্বর মাহাতো, শ্রী গোপাল চন্দ্র দাস, শ্রী দীনেশ সরকার,, শ্রী ররেন দত্ত, শ্রী সুনিল গুপ্তা, শ্রী ররেন্দ্র নাথ রায়,,শ্রী প্রেমানন্দ দে,শ্রী পঞ্চানন সাহু, শ্রী সীতারাম মাহাতো, শ্রী নাগছেদি বাসফোর,শ্রী তোফিয়া বাসফোড় আরো অনেকে।
মাননীয় শ্রীমতি মমতা ব্যানার্জির রেলমন্ত্রীর রাজত্বকালে ২০০৯ সালে পুনরায় রাজাভাতখাওয়া- জয়ন্তী ট্রেন চালাতে সমীক্ষা শুরু করে। রাজ্য তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক শ্রী মৃদুল গোস্বামী মহাশয় এর নেতৃত্বে প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে জয়ন্তীতে IRCTC পর্যবেক্ষক দল এসেছিল।আজ রাজ্যের শাসক দল চেষ্টা করলে পুনরায় ১৩ কিমি রাজাভাতখাওয়া থেকে জয়ন্তী ট্রয় ট্রেন রুপে রেল চলাচল বহাল করে এই রেলপথটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে।ধন্যবাদ।
(তথ্যসূত্র জয়ন্তীর সেই সময়ের পুরানো স্থানীয় বাসিন্দাদের স্মৃতি থেকে,এর সত্যতা আমি যাচাই করি নি)
( পুরানো ছবি গুলি মাননীয় শ্রী অমল রায় ঘটক স্যারের থেকে সংগৃহীত)

